ইলেকট্রন
পরমাণুর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় কক্ষে এস, পি ও ডি অরবাইটালের ইলেক্ট্রন-ঘনত্ব বিন্যাসের তাত্বিক পরিমাপ রং দিয়ে দেখানো হয়েছেঃ কালো মানে ঘনত্ব শূন্য, সাদা মানে সর্বোচ্চ ঘনত্ব, লালের মধ্যে কালচে বা সাদাটে ভাবের তারতম্যে বিভিন্ন মাঝারি ঘনত্ব দেখানো হয়েছে | |
গঠন | মৌলিকা কণিকা |
---|---|
পরিসংখ্যান | ফার্মিয়ন |
প্রজন্ম | প্রথম |
মিথষ্ক্রিয়া | অভিকর্ষ, তাড়িতচৌম্বক মিথস্ক্রিয়া, দুর্বল মিথস্ক্রিয়া |
প্রতীক | e-, β- |
প্রতিকণা | পজিট্রন |
তত্ত্ব | জি. জনস্টোন স্টোনি (১৮৭৪) |
আবিষ্কার | জে. জে. টমসন (১৮৯৭) |
ভর | ৯.১০৯ ৩৮২৬ (১৬) × ১০–৩১ কেজি ৫.৪৮৫ ৭৯৯ ০৯৪৫(২৪) × ১০–৪ এএমইউ ১⁄১৮২২.৮৮৮ ৪৮৪৯(৮) এএমইউ ০.৫১০ ৯৯৮ ৯১৮(৪৪) MeV/c২ |
ইলেকট্রিক চার্জ | –১.৬০২ ১৭৬ ৫৩(১৪) × 10-১৯ C |
Spin | ½ |
আবিষ্কারের ইতিহাস
প্রাথমিক পর্যায়
বিজ্ঞানী জি. জনস্টোন স্টোনি সর্বপ্রথম তড়িৎ রসায়নে ইলেকট্রনকে আধানের একটি একক হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং তিনিই ১৮৯১ সালে ইলেকট্রন নামকরণ করেন। ১৮৯০-এর দশকে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী বলেন যে তড়িৎ বিচ্ছিন্ন একেকের দ্বারা গঠিত হতে পারে এবং এভাবেই এ বিষয়ে সবচেয়ে ভাল ধারণা করা সম্ভব। এই এককগুলোর অনেক নামই প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু তখনও পর্যন্ত বাস্তব ভিত্তিতে এর প্রমাণ দেয়া সম্ভব হয়নি।টমসনের পরীক্ষা
ইলেকট্রন যে একটি উপআনবিক কণিকা তা সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী জে. জে. টমসন ১৮৯৭ সালে আবিষ্কার করেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিশ গবেষণাগারে ক্যাথোড রশ্মি নল নিয়ে গবেষণা করার সময় তিনি এই আবিষ্কার করেন। ক্যাথোড রশ্মি নল হল একটি সম্পূর্ণ বদ্ধ কাচের সিলিন্ডার যার মধ্যে দুইটি তড়িৎ ধারক (electrode) শূণ্য স্থান দ্বারা পৃথ করা থাকে। যখন দুইটি তড়িৎ ধারকের মধ্যে বিভব পার্থক্য প্রয়োগ করা হয় তখন ক্যাথোড রশ্মি উৎপন্ন হয় এবং এর ফলে নলের মধ্যে আভার সৃষ্টি হয়। উপর্যুপরী পরীক্ষার মাধ্যমে টমসন প্রমাণ করেন যে চৌম্বকত্বের সাহায্যে রশ্মি থেকে ঋণাত্মক আধান পৃথক করা যায় না; তবে তড়িৎ ক্ষেত্র দ্বারা রশ্মিগুলোকে বিক্ষিপ্ত করা যায়। মূলত ইলেকট্রনের আবিষ্কার এবং এর অংশসমূহ সম্বন্ধে ধারণা লাভ করতে গিয়ে টমসনকে তিন তিনটি পরীক্ষা সম্পাদন করতে হয়েছিলো:প্রথমত:
এই পরীক্ষার সাথে ১৮৯৫ সালে জ্যাঁ পেরিন কৃত পরীক্ষার বেশ মিল ছিল। টমসন এক জোড়া ধাতুর সিলিন্ডার দ্বারা একটি ক্যাথোড রশ্মি নল তৈরি করেন যার মধ্যে একটি সংকীর্ণ ফাঁক ছিল। এই সিলিন্ডারদ্বয় আবার একটি ইলেকট্রোমিটারের সাথে সংযুক্ত ছিল যাতে তড়িৎ আধান সংরক্ষণ এবং পরিমাপ করা যায়। পেরিন দেখেছিলেন ক্যাথোড রশ্মি একটি তড়িৎ আধান জমা করে। টমসন দেখতে চেয়েছিলেন একটি চুম্বকের মাধ্যমে রশ্মিগুলো বাঁকিয়ে রশ্মি থেকে আধান পৃথক করা যায় কি-না। তিনি দেখতে পান রশ্মিগুলো যখন সিলিন্ডারের সরু ফাঁকে প্রবেশ করে তখন ইলেকট্রোমিটারে ঋণাত্মক আধানের আধিক্য দেখা যায়। রশ্মিগুলো বাঁকিয়ে দিলে মিটারে ঋণাত্মক আধানের পরিমাণ এতো হয়না, কারণ রশ্মি তখন ফাঁকে প্রবেশেরই সুযোগ পায় না। এ থেকে স্পষ্টতই ধারণা করে নেয়া যায় যে ক্যাথোড রশ্মি এবং ঋণাত্মক আধান যেভাবেই হোক একসাথে থাকে, এদের পৃথক করা যায় না।
দ্বিতীয়ত:
পদার্থবিজ্ঞানীরা তড়িৎ ক্ষেত্রের সাহায্যে ক্যাথোড রশ্মি বাঁকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এবার টমসন একটি নতুন পরীক্ষণের কথা চিন্তা করেন। একটি আয়নিত কণা তড়িৎ ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হলে অবশ্যই বেঁকে যাবে, কিন্তু যদি একে যদি একটি পরিবাহী দ্বারা ঘিরে দেয়া হয় তবে আর বাঁকবে না। তিনি সন্দেহ করেন যে নলের মধ্যে বিরাজমান গ্যাস বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্যাথোড রশ্মির কারণেই তড়িৎ পরিবাহীতে পরিণত হয়েছে। এই ধারণা প্রমাণ করার জন্য অনেক কষ্টে তিনি একটি নলকে প্রায় বিশুদ্ধ শূণ্যস্থান করতে সমর্থ হন। এবার পরীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় ক্যাথোড রশ্মি তড়িঃ ক্ষেত্র দ্বারা বেঁকে যাচ্ছে। এই দুইটি পরীক্ষণ থেকে টমসন সিদ্ধান্তে পৌঁছান,
আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছা থেকে কোন ভাবেই পালাতে পারিনা যে ক্যাথোড রশ্মি হল ঋণাত্মক তড়িতের আধান যা পদার্থের কণিকা দ্বারা বাহিত হয়।.... এই কণিকাগুলো কি? এরা কি পরমাণু, অথবা অণু, অথবা এমন পদার্থ যা এখন পর্যন্ত উপবিভাগের একটি সূক্ষ্মতম পর্যায়ে রয়েছে?তৃতীয়ত:
টমসনের তৃতীয় পরীক্ষার বিষয়বস্তু ছিল কণিকাসমূহের মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুসন্ধান করা। তিনি যদিও এ ধরণের কোন কণিকার সরাসরি ভর বা আধান বরে করতে পারেন নি, তবে চুম্বকত্বের দ্বারা এই রশ্মিগুলো কতটা বাঁকে এবং এদের মধ্যে কি পরিমাণ শক্তি রয়েছে তা পরিমাপ করতে পেরেছিলেন। এই উপাত্তগুলোর মাধ্যমে তিনি একটি কণিকার ভর এবং এর তড়িৎ আধানের মধ্যে একটি অনুপাত বের করেন। নিশ্চয়তার জন্য তিনি অনেক ধরণের নল এবং গ্যাস নিয়ে পরীক্ষণ সম্পাদন করার মাধ্যমে উপাত্তগুলো সংগ্রহ করেন। এই অনুপাত থেকে বেশ আশ্চর্যজনক ফল পাওয়া যায়; এর মান একটি আয়নিত হাইড্রোজেনের তুলনায় এক হাজার গুণেরও বেশি ছোট হয়।
পরবর্তী যুগ
অনুপাতের পরিমাণটি এতো ছোট হওয়ার বিষয়টি পরীক্ষণের পর এমিল ওয়াইখার্ট (Emil Wiechert) উত্থাপন করেন। এ হিসেবে, হয় ক্যাথোড রশ্মির আধানের পরিমাণ বিপুল (আয়নিক পরমাণূর তুলনায়) অথবা তারা তাদের আধানের তুলনায় আশ্চর্যজনকভাবেই হালকা। এই দুটি সম্ভাবনার মধ্যে বেছে নেয়ার বিষয়টি ফিলিপ লিনার্ড নির্দিষ্ট করেন। ক্যাথোড রশ্মি কিভাবে গ্যাসের বাঁধা অতিক্রম করে তা নিয়ে পরীক্ষা করে তিনি দেখান যে, ক্যাথোড রশ্মি যদি কণিকা হয় তবে তার ভর অতি ক্ষুদ্র হতে হবে, যেকোন পরমাণুর চেয়েও অনেক ক্ষুদ্র। অবশ্য এর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তখনও দেয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে গবেষণায় নির্দিষ্ট মান বেরিয়ে এসেছে। যেমন ১৯০৯ সালে রবার্ট মিলিকান তার তৈল-বিন্দু পরীক্ষার সাহায্যে ইলেকট্রনের আধান নির্ণয় করেন। টমসন দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে,ক্যাথোড রশ্মির মধ্যে আমরা পদার্থের একটি নতুন অবস্থার সন্ধান পাই, এটি এমন এক অবস্থা যাতে পদার্থের উপবিভক্ত অংশগুলোও সাধারণ গ্যাসীয় অবস্থার তুলনায় অনেক বেশি বাহিত হয়: এমন এক অবস্থা যাতে সকল পদার্থ একটি এবং একই শ্রেণীর; এই পদার্থটিই সেই সারবস্তু যা থেকে সকল রাসায়নিক মৌলসমূহ সৃষ্টি হয়েছে।পর্যায়বৃত্ত ধর্ম অনুসারে মৌলসমূহের রাসায়নিক ধর্ম পর্যায়বৃত্তভাবে ব্যাপকহারে পরিবর্তীত হয়্এবং এটিই বর্তমান পর্যায় সারণীর ভিত্তি রচনা করেছে। এই তত্ত্বটিকে আদিতে পারমানবিক ভর দ্বারা ব্যাখ্যা করা হতো, কিন্তু পারমানবিক ভরের ক্রম ঠিক না থাকায় এ নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। ১৯১৩ সালে বিজ্ঞানী অঁরি মোসলে পারমানবিক সংখ্যার ধারণা প্রবর্তন করেন এবং প্রতিটি পরমাণুর মধ্যস্থিত প্রোটন সংখ্যা দ্বারা পর্যায়বৃত্ত ধর্ম ব্যাখ্যা করেন। এতই বছর নিল্স বোর দেখান যে ইলেকট্রনই প্রকৃতপক্ষে পর্যায় সারণীর মূল ভিত্তি। ১৯১৬ সালে গালবার্ট নিউটন লুইস ইলেকট্রনীয় মিখস্ক্রীয়ার মাধ্যমে রাসায়নিক বন্ধন ব্যাখ্য করেন।
শ্রেণীবিভাগ
ইলেকট্রন লেপ্টন নামক অধঃপারমানবিক কণার শেণীতে অবস্থিত। এদেরকে মৌল কণিকা হিসেবে ধরা হয়, অর্থাৎ এদেরকে আরও ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করা সম্ভব নয়। অন্যান্য কণার মত ইলেকট্রনও তরঙ্গ হিসেবে আচরণ করতে পারে। এই আচরণটিকে তরঙ্গ-কণা দ্বৈত আচরণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পদার্থবিজ্ঞানে এর অপর নাম কমপ্লিমেন্টারিটি, এই নামটি বিজ্ঞানী নিল্স বোর কর্তৃক প্রদত্ত। দ্বি-চির পরীক্ষা দ্বারা এটি প্রমাণ করা যায়।ইলেকট্রনের প্রতিকণিকার নাম পজিট্রন। বোঝাই যাচ্ছে যে পজিট্রনের ভর হুবহু ইলেকট্রনের সমান কিন্তু আধান ধনাত্মক হওয়ার পরিবর্তে ঋণাত্মক, যদিও আধানের মান সমান। পজিট্রনের আবিষ্কারক কার্ল ডেভিড এন্ডারসন আদর্শ ইলেকট্রনকে নেগেট্রন নামে ডাকার প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইলেকট্রন নামটি একটি সাধারণ শব্দ হিসেবে ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক উভয় আধান বোঝাতে ব্যবহার করা উচিত। তবে এই প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় নি।
0 comments:
Post a Comment